মানব জীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা

Submitted by Nandarani Pramanik on Mon, 11/04/2019 - 21:51

Fairsভূমিকা :– 'মেলা' কথাটির মধ্যে আছে মিলনের ইঙ্গিত । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমরা গিয়ে এক জায়গায় মিলিত হই । সম্মিলিত মানুষের সমাবেশেকেই মেলা বলে । প্রত্যেক মেলার একটা উপলক্ষ থাকে ঠিকই, কিন্তু একসময় সেটা একেবারেই গৌণ হয়ে যায় । লক্ষ্য হয়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে মিলেমিশে কিছু দেওয়া-নেওয়া বা আদান-প্রদান । মেলা হল মিলনের ক্ষেত্রে । মিলনের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় ।

নানারকমের মেলা:– সারা বছর ধরে কোনো না কোনো জায়গায় মেলা হয়ে চলেছে । মেলার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় থাকে না । কখনো চৈত্র সংক্রান্তির বিকেলে, কখনো আষাঢ়ের বৃষ্টি ভেজা দিনে । শীতের সকালেও বসে পৌষ সংক্রান্তির মেলা । নানারকম বিষয়কে কেন্দ্র করে মেলা বসে । (১) ধর্মীয় মেলা — গঙ্গাসাগরের মেলা, হরিদ্বারে বা প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা, পুরীর জগন্নাথের রথের মেলা, নবদ্বীপে শান্তিপুরের রাসের মেলা,  চন্দন নগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর মেলা, তারকেশ্বরের গাজন ইত্যাদি ।

(২) বিভিন্ন মনীষী স্বরণে মেলা — যেমন বাংলার কান্তকবি জয়দেবের স্মরণে কেন্দুলিতে মেলা বসে, এক মাস ধরে । নদীয়ায় ফুলিয়ায় রামায়ণের অনুবাদক কবি কৃত্তিবাসের স্মরণে মেলা বসে । ছাতনায় চন্ডীদাসের মেলা প্রভৃতি । শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা খুবই বিখ্যাত । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন । সেই ঘটনার স্মরণেই ১৩০২ সালের ৭ই পৌষ এই মেলার সূচনা হয় । যা এখনো সমহিমায় চলছে ।

(৩) আধুনিক মেলা — বর্তমান সময়ে মেলারও নানান পরিবর্তন ঘটেছে । আধুনিক জীবন নগর কেন্দ্রিক হওয়ায় শহরে প্রচলিত হয়েছে বাণিজ্য মেলা, শিল্প মেলা, বই মেলা, খাদ্য মেলা, সংস্কৃতি মেলা, পর্যটনশিল্পের মেলা প্রভৃতি । আরো নানান ধরনের মেলা বসছে নিত্যদিন ।

মেলার সাধারণ চিত্র : — মেলা মানেই প্রচুর মানুষের সমাগম । ফলে ভিড়, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি, হট্টগোল, হরেক রকম বাঁশির আওয়াজ থাকবে । আর থাকবে রঙ বেরঙের পোশাক পরা বহু ভাষাভাষীর মানুষজন । মনভোলানো জিলাপি, জিভেগজা থেকে শুরু করে চপ, বেগুনি, ফুচকা বিরিয়ানির সমারোহ প্রতিটি মেলায় থাকবে । খাবারের ব্যাপারে 'নো কম্প্রোমাইজ' । মেলার আর একটা জনপ্রিয় আকর্ষণ ম্যাজিক শো, সার্কাস শো, যাত্রা, বাউল গানের আসর, বড় ও ছোটদের নাগরদোলা, নানা রকমের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা । এছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র থাকে । সব দিক থেকেই লক্ষ্য করলে দেখা যায় মেলায় মানুষ সব দিক থেকেই উপকৃত হয় এবং উপভোগ করে সমানে ।

মেলার প্রয়োজনীয়তা :— মানব মনের অনাবিল আনন্দের জন্য, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের জন্য, অজানা বিষয় বা জায়গাকে ভালো ভাবে জানার জন্য, মেলার প্রয়োজন আছে । এ ছাড়া অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও মেলার ভূমিকা রয়েছে । মেলায় প্রচুর জিনিস বেচাকেনা হয় । স্থানীয় মানুষজনের তৈরি জিনিস যেমন মেলায় বিক্রি হয় তেমনি বিভিন্ন জায়গা থেকেও উৎপাদিত জিনিস মেলায় বিক্রি হয় । এতে অর্থনৈতিক দিকের ও অনেকটা উন্নতি হয় । এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় কারণেও মানুষ মেলায় উপস্থিত হয় । ধর্মীয় আদান-প্রদান ও হয় এখানে ।

উপসংহার : মেলা লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী । মেলায় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের আগমন ঘটে বলে এখানে মানুষ যেমন আনন্দ উপভোগ করে তেমনি মানুষের মন থেকে সংকীর্ণ জাতিভেদ, ধর্মভেদ দূর হয় । মানুষ একত্রে মিলিত হয় । মেলা হল সৃজনশীলতার একটা ক্ষেত্র । এখান থেকে অনেক শিল্পীর জন্ম হয় । গানের শিল্পী, মৃৎশিল্পী, ভাস্কর্যের শিল্পীর সন্ধান পাওয়া যায় । বহু অখ্যাত গ্রাম খ্যাতির আলো পায় । মেলার হট্টগোলে সাধারণ জীবনযাত্রায় কিছুটা অসুবিধা হয় ঠিকই কিন্তু সেটা বাদ দিলে লাভের পাল্লাই থাকে বেশি । তাই যুগ যুগ ধরে মেলা বসে চলেছে — আর যুগ যুগ ধরেই চলবে ।

***

Comments

Related Items

ছাত্র জীবনে খেলাধূলার প্রয়োজনীয়তা

'ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ' । ছাত্রছাত্রীদের প্রধান কাজ হল পড়াশুনা করা । পড়াশুনাকে তপস্যার মতো করেই করা দরকার ।

বিশ্বের ত্রাস মহামারী করোনা

ভুমিকা:- একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতার শিখরে বাস করেও মানুষ ভয়ঙ্কর এক মহামারির মোকাবিলা করতে পারেনি । সেই মহামারি হল করোনা । ধনী বা দরিদ্র কোন দেশই করোনা নামক মহামারির কবল থেকে রেহাই পায়নি । করোনা এমনই এক রোগ যা অতি দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করে । এটা নতুন রো

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি । / দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী — / মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, / কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু / রয়ে গেল অগোচরে । বিশাল বিশ্বের আয়োজন ; / মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ ।" — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

যুগে যুগে বাংলার বুকে যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অন্যতম । ঈশ্বরচন্দ্রের পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্মনিষ্ঠা, নির্ভীকতা, হৃদয়বত্তা মানবসমাজে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত । হিমালয়ের মতো বিশাল ও উন্নত মনের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর ছিলেন না, করুণার সিন্ধুও ছিলেন ।

রক্তদান — মানবকল্যাণের আর এক নাম

"দেহের একটু রক্ত দিলে যদি বাঁচে একটি প্রাণ, / ধন্য হবে জনন তোমার, মহৎ তোমার দান । "